1970-12-09
Page: 4
Editorial
পাকিস্থানী জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। ভোটাভুটি শেষ হয়েছে। এখন ভোট গণনা চলছে। বুধবার হয়ত চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। পূর্ব বাংলার আওয়অমী লীগের জয়জয়াকার। এ অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে দু-চারটি ছাড়া আর সবগুলো তাদের দখলে এলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। দশটি আসনের নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ওগুলোর ফয়সালা হবে। জনসাধারণ নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুকছেন। জনতার আস্থা এ সংস্থার উপর। জাতীয় পরিষদে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ১৩০। অতিরিক্ত ১৩ জন মহিলা সদস্য জাতীয় পরিষদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। পূর্ব বাংলার জন্য বরাদ্দ ৭টি মহিলা আসন। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান সম্ভবতঃ নিরঙ্কুশ স্যখ্যাধিক্য নিয়ে জাতীয় পরিষদে যাবেন। যদি তা নাও পারেন তবে পশ্চিম পাকিস্তানের দু-চারজনকে অবশ্যই তিনি সঙ্গে পাবেন। ফল যা দাঁড়াবে তাতে মনে হয়, পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জাতীয় পরিষদের কোন কাজই চলবে না। গণতান্ত্রিক শক্তি পরীক্ষায় জাতীয় ভিত্তিতে পূর্বের বাঙালীর প্রাধান্য প্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের সংহতি নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। অন্যান্য দল ছিটকে পড়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি জনমন জয় করেছে। এদল নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের পরেই জাতীয় পরিষদে স্থান পাবে। জনপ্রিয়তার পিপলস পার্টি পূর্বের আওয়ামী লীগের সমকক্ষ না হলেও দ্বিতীয় সারিতে জায়গা নেবে। নির্বাচনে একটা সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পূর্ব বাংলায় পিপলস পার্টির কোন পাত্তা নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রায় অস্তিত্বহীন। পূর্ব-পশ্চিমের সমন্বয়ের উপরই তৈরী হবে আগামী দিনের সংবিধান। আওয়ামী লীগ এবং পিপলস পার্টির সমঝোতা না হলে অচল অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। সংখ্যাধিক্যের মতামতের মূল্য কতখানি থাকবে সে সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান কোন ইঙ্গিত দেন নি। সংবিধান রচনার সময় মাত্র ১২০ দিন। এর মধ্যে সংবিধান রচিত না হলে এবং ইয়াহিয়া খান মেয়াদ না বাড়ালে পাকিস্তান আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে। গাড়ীর চাকা পিছন দিকে ঘুরবে। জনগণের মনে আসবে গভীর হতাশা। ঘটবে সামরিক শাসনের কড়াকড়ি। প্রথম পর্যায়ে জাতীয় পরিষদ কাজ করবে গণপরিষদ হিসাবে। তারপর ওটা হবে সত্যিকারের জাতীয় পরিষদ। সংবিধান রচিত এবং গৃহীত হবার পরই ইয়াহিয়া খান করবেন ক্ষমতা হস্তান্তর। তার আগে নয়। গণপরিষদ সার্বভৌম সংস্থা নয়। তার রচিত সংবিধান গ্রহণে ডিকটেটর ইয়াহিয়া খান বাধ্য নন। সম্ভাব্য সংবিধান চালু করতে হলে তার মর্জির নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। ইয়াহিয়া খান চান পূর্ব এবং পশ্চিমের গ্রহণযোগ্য সংবিধান। পাকিস্তানের দুটি অংশের শিথিল সাংবিধানিক যোগাযোগ তিনি বরদাস্ত করবেন না। ইয়াহিয়া খান যখন পশ্চিমের কথা বলেন তখন তিনি ভুলে যান যে, পশ্চিম এখন আর এক ইউনিট নয়। ওটা চারটি রাজ্যে বিভক্ত। সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পূর্ব বাংলার মতই পাঞ্জাবী প্রাধান্য অতিষ্ঠ। ব্যাপক আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য তাদেরও কাম্য। ভুট্টোর দুরুত্ব এখন খুব বেশী। পূর্ব বাংলার দাবী তিনি কতখানি মানবেন তা নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল স্পষ্ট। তিনি একসঙ্গে পিকিং সমর্থক এবং ঐশ্লামিক সমাজতন্ত্রের উদ্গাতা। সহজে তিনি বাঙালীর প্রাধান্য স্বীকার করবেন না।
আওয়ামী লীগের উপর রয়েছে পূর্বের বাঙালীর ম্যান্ডেট-আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। এ অধিকার আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েই আওয়ামী লীগের নেতারা নেমেছিলেন নির্বাচনী ময়দানে। তাঁদের ছয় দফা দাবী জাতীয় চার্টার। এতে আছে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে রেখে আর সব কিছুই রাজ্যগুরোর হাতে ছেড়ে দেবার সুপারিশ। প্রত্যেকটি রাজ্য গড়ে তুরবে নিজস্ব মিলিসিয়্ পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে হাজার মাইল দূরে। তার মিলিসিয়ার দরকার সব চেয়ে বেশী। এ দাবী অবশ্যই পাঞ্জাবীরা সন্দেহের চোখে দেখবে। ভুট্টোর উপর নি:সন্দেহে কায়েমী স্বার্থের চাপ পড়বে। তিনি হয়ত বাঙালীর সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন না। বাস্তব প্রয়োজনে মুজিবরকে হয়ত কিছুটা নেমে আসতে হবে। তা না হলে অবস্থার সুযোগ নেবেন ইয়াহিয়া খান। সর্ব পাকিস্তান ভিত্তিতে কোন দল না থাকার অসুবিধা দেখা দেবে সর্বস্তরে। নির্বাচনে জনমতের রায় পাওয়া গেলেও ইয়াহিয়া খানের রায় অত্যাবশ্যক। তাঁর হাতের মুঠোয় পাকিস্তানের গণতন্ত্র। পশ্চিমের কায়েমী স্বার্থের জিম্মাদাররা সহজে ছাড়বেন না। নির্বাচনে হারলেও গুন্ডামীতে তারা হারবেন না। শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান তাদের দিকে হয়ত ঝুকে পড়ার চেষ্টা করবেন। বিপদ এখানে। আওয়ামী লীগের এবং পূর্ব বাংলার জয়ের উল্লাস স্থায়ী হতে সময় লাগবে। সামনে রয়েছে হরেক রকমের প্রতিবন্ধক। তার মধ্যে প্রধান স্বর্য় ইয়াহিয়া খান। আগামী চার মাস প্রতীক্ষার সময়। সঙ্কটের পর সঙ্কট আসবে। বেরিয়ে আসার পথ পরিস্কার নয়। বাঙালী তার মতামত দিয়ে দিয়েছে। পূর্ব বাংলার ইচ্ছাার বিরুদ্ধাচরণ গণতন্ত্রের অপমৃত্যু। এ অপমৃত্যু যদি ইয়াহিয়া খানের হাতে ঘটে তবে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। পশ্চিম থেকে পূর্ব একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।