1970-12-10
By কৃষ্ণ ধর
Page: 4
Editorial
অবাক হবার মতো ঘটনাই। পাকিস্তানের দুই অংশে দুই তরূণ নেতা আর সকলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলেন বিজয় গৌরবে। জাতীয় আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের বয়স ৫০। পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ৪৩ বৎসরের তরুণ। পূর্ব ও পশ্চিমকে নিয়ে পাকিস্তানের শাসকদের গোড়া থেকেই মাথা ব্যথা। পূর্ব যা চায় পশ্চিম তাতে গররাজী। পশ্চিম যা ভালো মনে করে পূর্বের মানুষের কাছে তা অগ্রাহ্য। মাঝখানে যদি দেড় হাজার মাইলের ভারত-ভূখন্ড না থাকত তাহলে হয়তো পাকিস্তানের জাতীয় অস্তিত্ব এই দ্বৈত মনোভাব এতটা প্রকট হত না। ভৌগোলিক সন্নিহিত যে একটা জাতির সংহতির পক্ষে কত প্রয়োজন খন্ডিত ও পোকায়-খাওয়া পাকিস্তান (মহম্মদ আলী জিন্নাহ্ উক্তি, ১৯৪৭) কায়েম হবার পর পাকিস্তানের শাসকরা বুঝেছেন। এখন আরও বুঝবেন।
মুজিবরের ন্যাশনাল আওয়ামী লীগের এই জয় প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু এমন তর্কাতীত আধিপত্য বোধহয় কল্পনার ছিল না। বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী এবং প্রবীণ আতাউর রহমানের দল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে সম্মান বাঁচিয়েছেন। পূর্ব বাংলায়, যাকে মুজিবর ‘বাংলা দেশ’নাম দিতে চান, তাঁর জনপ্রিয়তা সংগঠন শক্তি এবং রাজনৈতিক দক্ষতা আজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুটো আসন তাঁর হাত ছাড়া হয়েছে। কিন্তু সে দুটি আসনেও ব্যক্তিগত কারণেই প্রার্থীরা জিতেছেন। ঝঞ্চা-বিধ্বস্ত এলাকায় বাকী ন’টি আসনের ফলাফলও প্রায় নিশ্চিন্ত। গণ-পরিষদের সদস্যদের বারো বা তেরো জন মহিলা নির্বাচিত হবেন তার মধ্যেও আওয়ামী লীগ অর্ধেক আসন দখল করতে পারবে। সুতরাং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে মুজিবর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তাঁর হাতে আসবেই।
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস- পার্টির জয় অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। ভুট্টোর পার্টি নতুন। এই সেদিনও তিনি ছিলেন আয়ুবের মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি পার্টি গড়লেন। তিনি যে এত অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ঝুনো রাজনীতিক, কট্টর মোল্লামৌলভী-উলেমাদেরকে ধরাশায়ী করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করে নেবেন তা গণনার মধ্যে ছিল না অনেকেরই। সিন্ধু প্রদেশের লোক তিনি। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধীদের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রাধান্য এমন নয় যে, তিনি আসবে নামা মাত্র সকলে তাঁর নেতৃত্বে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু শুধু সিন্ধুতে নয়, পাকিস্তানে নব্য-বুর্জোয়া ক্ষমতার-স্বাদ-পাওয়া পাঞ্জাবে ৮০টি আসনের মধ্যে ৬০টি ভুট্টোর দখলে। এমন কি বালুচিতস্তানেও পিপলস্ পার্টির অনুপ্রবেশ এক বিস্ময়কর ঘটনা।
এর একটি মাত্র কারণ মনে হয় পাকিস্তানে, যেমন ঘটছে ভারতেও, তরুণ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। পাকিস্তানে প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কিংবা তার সমসাময়িক কালে যারা জন্মেছিল তারা তখন যুবক। পুরনোদের বাতিল করে দিয়ে এই যুব সম্প্রদায়, ভারতের যুবক বা যে কোনো দেশের যুবকদের মতোই যারা ক্ষুব্ধ, রাষ্ট্র ও হতাশ, তারা জুলফিকারের তারুণ্যের উদ্যম, সাহসিকতা এবং নেতৃত্বের মধ্যে নিজেদের আশা আকাংক্ষার প্রতিফলন দেখেতে চেয়েছে। এবং প্রবীণতার যারা মুসলীম লীগ যুগের স্মৃতি যাদের মন থেকে এখনো মুছে যায়নি, তারাও ভুট্টোর ইসলামীপনার ধোঁকায় তারা ভোলেনি। ভুট্টোর মধ্যে তাঁরা একই সঙ্গে ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের রুপায়ণের আশা দেখছেন।
পূর্ব পাকিস্তান এর আগেও একবাক্যে পাকিস্তানের সামরিকবাহিনী নিয়ন্ত্রিত একনায়কী শাসন ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নিজাম-ই-ইসলামীর যুক্তফ্রন্ট ফজলুল হকের নেতৃত্বে ২৩৭টির মধ্যে ২২৩টি আসন দখল করেছিল। ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ পেয়েছিল মাত্র ৯টি আসন। ষোল বছর পর মুজিবর রহমান সেদিনের প্রতিবাদকেই আরও তীব্র স্পষ্ট এবং নিঃসংশয় করলেন এককভাবে, অন্য কোনো দলের সহায়তা না নিয়েই। কেন এই জয়? তার কারণও সবার জানা। মুজিবর পূর্ব পাকিস্তানের সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের ডাক দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দফতর ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা দিতে নারাজ। এক কেন্দ্রিক নয়, ফেডারেল গণতন্ত্র রূপান্তরিত করতে চান তিনি পাকিস্তানকে। এই দাবী আজ নতুন নয়। পূববাংলার স্বাতন্ত্র্য ও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্টতর সম্পর্কের কথা বলার অপরাধে যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী শের-ই-বাঙ্গলা ফজলুল হক অপসারিত হয়েছিলেন। মুজিবরের চিন্তাও তখন থেকেই। এই অপরাধে মুজিবরকে আয়ুব খাঁর আমলে অকথ্য নির্যাতন ও কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছে। তাঁর মিথ্যা মামলা জুড়ে দিয়ে পূর্ব বাংলার এই সাহসী জননেতাকে বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্রদোহী বানাবার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। মনে হয়েছিল মুজিবর আর কোনদিন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। অনেকবার তাঁকে ক্ষমতার প্রলোভন দেখানো হয়েছে। মুজিবর ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন আয়ুবের সেই প্রস্তাব। কখন মরিয়া হয়ে এক সাংঘাতিক রাষ্ট্রদোহের মামলার আসামী করা হয় তাঁকে, মামলা “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলা নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। সেই মামলার এক রাজসাক্ষীকে ঢাকা জেলে গুলী করে হত্যা করে আয়ুবের ফৌজ। তবু শেষ পর্যন্ত মামলা টিকল না। দীর্ঘদিন কারাগরে রেখে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে মুজিবরকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার কিছুদিন পরই আয়ুব বিদায়- ইয়াহিয়ার মঞ্চে প্রবেশ। গুলী-খাওয়া বাঘের মতো ফরিদপুরের মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান মনে প্রাণে বাঙালী শেখ মুজিবর রহমান আবার দাবি তুললেন, পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে। পঞ্চান্ন শতাংশ অধিবাসীর বাস পূর্ব পাকিস্তান তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার কোনো মর্যাদা পায়নি। বরং পঃ পাকিস্তানীরা একে কাঁচামাল সংগ্রহের কলোনিতে পরিণত করে রেখেছে। অনুগ্রহ নয়, অধিকার। কলোনির নয়, পূর্ণস্বায়ত্ত শাসন-মুজিবর ছয় দফা দাবি তুললেন সমগ্র পাকিস্তানবাসীর কাছে। পাকিস্তানকে যদি এক রাখতে হয় তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে নিয়েই তাকে এক থাকতে হবে। বেয়েনেটের জোরে নয়। এই দাবি তিনি খোলাখুলিই করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা যে তাঁর পিছনে আছেন গত সোমবারের নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। মুজিবর নিঃসন্দেহে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতার দাবি রূপে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তা সত্য নয়। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হলেও তা বহুভাষী ও বহু জাতি অধ্যুষিত-এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু এক ধর্ম জাতি বা এক রাষ্ট্র গড়ে তোলেনা। তাহলে আরবদেশে এতগুলো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকত না। মুজিবর কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার দাবি তোলেননি। তিনি বাঙ্গালীদের জন্য তাদের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্জন করতে চেয়েছেন।
মুজিবর ভারত-ঘেষা বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। আসলে তিনি যা চান তাহলো পাকিস্তান সরকারের অন্ধ ভারত-বিরোধিতার অবসান। কাশ্মীরের জন্য পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে উপোসী রাখছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশসুলভ বন্ধুত্বের নীতি পূর্ব বাংলা তথ্যা পাকিস্তানের স্বার্থেই আজ প্রয়োজন। মুজিবর একথাটাই বলতে চেয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছেন মুজিবরের উপর। মুজিবর ক্ষমতায় এলে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরাও ফিরে পাবেন নাগরিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা। উদ্বাস্তু বিতাড়নও বন্ধ হবে।
ইয়াহিয়া খান কী করবেন ? তিনি হয়তো আশা করেছিলেন বহু পার্টি পরস্পরের সঙ্গে মারামারি করে সংবিধান তাঁর নির্ধারিত সময়-সীমার মধ্যে তৈরী করতে পারবেন না। এখন সবটাই নির্ভর করছে মুজিবর ও ভুট্টোর সহযোগিতার ওপর। ভুট্টো রাজনীতিতে বিচক্ষণ, চৌখস বক্তা (তিনি বাংলাও শিখে নিয়েছেন) এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন। তাঁর ভারত-বিরোধিতা সুবিদিত। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভাঙ্গার পক্ষপাতী হলেও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার রাখার পক্ষে। পররাষ্ট্রনীতিতে মুজিবর ও জুলফিকার জোট-নিরপেক্ষতার দিকেই যাবেন। তবে বামপন্থী বা মার্কসবাদী না হলেও ভুট্টো সম্ভবত ভারত-বিরোধী নীতির সম্প্রসারিত শাখা হিসাবে রাশিয়ার চেয়ে চীনের সঙ্গে চলার পক্ষপাতী। মুজিবর যতদুর জানা যায়, রাশিয়া এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পক্ষে। কিন্তু এতে দুজনের বিরোধ দূরতিক্রম্য হবে না। আসল পরীক্ষা হবে ভুট্টোর দল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি কীভাবে গ্রহণ করেন। মুজিবর তাঁর বাংলা দেশের মানুষের কাছে যে-প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কোনো হেরফের করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের মানুষের কাছে এই নির্বাচনের ফলাফল নতুন অধ্যায় সূচনার সুযোগ এনে দিয়েছে। গণ-পরিষদ গঠিত হবার ১২০ দিনের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান তুলে দিতে হবে ইয়াহিয়া খাঁর কাছে। সে সংবিধান যদি ইয়াহিয়ার গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে কী হবে? মুজিবর ও ভুট্টোর সহযোগিতাই এ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দিতে পারবে। পাকিস্তানের নবজন্মের দায়িত্ব এদের হাতে। ভুট্টো যদি রাজী না হন তাহলে মুজিবর কি একাই তাঁর জাতির ভাগ্য নির্ধারণের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবেন না? পূর্ব পাকিস্তানের শৃঙ্খলিত মানুষ কোটি কন্ঠে বলবেন, মুজিবর, তোমার জন্যই আমরা এতদিন অপেক্ষা করেছিলুম। তুমি পূর্ব বাংলাকে স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠা করো।